কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়- এই হল পদার্থের তিনটি অবস্থা। তবে পদার্থের আরও একটি অবস্থা আছে; এই চতুর্থ অবস্থাটি হল প্লাজমা। নামটা শুনে হয়তো মনে হতে পারে যে প্লাজমা অবস্থাটি সচরাচর দেখা যায় না। তবে মজার ব্যাপার হল দৃশ্যমান জগতের বেশির ভাগটাই প্লাজমা। তাহলে প্রশ্ন হল কোথায় এই প্লাজমা?? সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র, বজ্রবিদ্যুৎ, আগুন এগুলিই হল প্লাজমা। আমাদের গোটা বিশ্বই নক্ষত্রময়। তাই দৃশ্যমান জগতের বেশিরভাগটাই প্লাজমা দিয়ে তৈরি।
পদার্থের তিন অবস্থা
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় অবস্থার কথা। কঠিন হল পদার্থের এমন অবস্থা যেখানে পদার্থের নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন আছে। এই অবস্থায় অনু বা পরমাণু নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করে কম্পনশীল অবস্থায় থাকে। যদি অনু- পরমাণুদের সজ্জা নির্দিষ্ট জ্যামিতিক প্রকৃতির হয় তবে সেটিকে কেলাস বা ক্রিস্টাল বলে। যেমন- খাদ্যলবণ, হিরা, গ্রাফাইট ইত্যাদি। অবশ্য অনু-পরমাণুদের সজ্জা অনিয়মিত হতে পারে। যেমন- সালফার, চক, কয়লা ইত্যাদি।
এখন কঠিন পদার্থে যদি তাপ প্রয়োগ করা হয় অর্থাৎ উষ্ণতা বৃদ্ধি করা হয় তাহলে কম্পরত কণাগুলি আরো বেশি করে কাঁপতে থাকে এবং এক সময় কেলাসের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্ন দিকে ছুটতে শুরু করবে। এই ঘটনাটি হল আসলে গলন। গলন প্রক্রিয়া শেষ হলে পদার্থটি কঠিন থেকে তরলে রূপান্তরিত হয়। এখন তরলের কোনো আকার না থাকলেও আয়তন থাকে। কঠিন পদার্থের কণাগুলির মধ্যে যে দূরত্ব এই অবস্থায় সেটা বেড়ে যায় ও নিজেদের মধ্যে যে আকর্ষণ বল কমে যেতে থাকে। তরল অবস্থায় কণার বেগ শূন্য থেকে শুরু করে অনেকটা হতে পারে। এটা কণার ব্যাসার্ধ, উষ্ণতার ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। এই অবস্থায় কণাগুলি নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষ ঘটাতে থাকে। একে ব্রাউনীয় গতি বলা হয়।
তরলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে তরলের কিছু কণা তরলস্তর ভেদ করে বায়ু মাধ্যমে প্রবেশ করে। এই ঘটনাকে বাষ্পীভবন বলা হয়। উষ্ণতা বৃদ্ধিতে এর পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। বাষ্পীভবন যখন তরলের সমগ্র অংশ থেকে হয় তখন একে স্ফুটন বলে। এর ফলের সমস্ত তরল বাষ্পে বা গ্যাসে পরিণত হয়।
পদার্থের চতুর্থ অবস্থা কোনটি ? -প্লাজমা
এবারে জানা যাক প্লাজমা সম্পর্কে। যখন কোনো পরমাণুকে প্রচুর শক্তি দেওয়া হয় তখন সেই পরমাণু তার বাইরের কক্ষের ইলেকট্রনকে এক এক করে বাইরে বের করে দিতে থাকে। শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আরও কাছের ইলেকট্রনগুলি বের হতে থাকে। এর ফলে নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের একটি মিশ্রণ তৈরি হয়। একেই প্লাজমা বলে।
William Crookes (1832–1919) পরীক্ষা করেন নিম্ন চাপে গ্যসে থেকে তড়িৎ ক্ষরণ হয়। Crookes এই নিঃসরণকে 'Radiant matter' নামে অভিহিত করেন। 1920 সালে Irving Langmuir ও তার সহকর্মীগণ আয়নিত গ্যাসের বর্ণনা করার সময় 'Plasma' শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপরে 'Radio Science' শাখায় প্লাজমা নিয়ে আরও গবেষণা ও আলোচনা হয় । এখানে বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে বায়ুমন্ডলের আয়োনোস্ফিয়ারে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ প্রবাহিত হয়। এই বিষয়ে গবেষণার জন্য 1947 সালে Edward V. Appleton নোবেল পুরস্কার পান। 1950 সালের মাঝামাঝি নিউক্লিয় বিভাজন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টায় 'hot plasma physics' নামে একটি শাখা তৈরি হয়। এখানে চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা প্লাজমাকে নিয়ন্ত্রন করার চিন্তা ভাবনা শুরু হয়।
এবারে দেখা যাক কয়েকটি প্লাজমার উদাহরণ
♦ সূর্য-
সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র হল নিউক্লিয় সংযোজন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট প্লাজমার বিশাল পিন্ড। এখনও বিজ্ঞানীরা সূর্যের প্লাজমা নিয়ে গবেষণা করে চলছে। সূর্যের কেন্দ্রে চাপ ও তাপের পরিমাণ অকল্পনীয়। এতটাই যে হালকা মৌলগুলির নিউক্লিয়াস মিলিত হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী নিউক্লিয়াস তৈরি করে চলছে আবিরত। আর তার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে তাপশক্তি।
2_1^1H\rightarrow \;_1^2H+e^+ +\nu_e
_1^2H+_1^1H\rightarrow\; _2^3He+\gamma
2_2^3He\rightarrow\; _2^4He+2_1^1H
ওপরের এরূপ বিক্রিয়ায় প্রতি চক্রে 26.21 MeV শক্তি তৈরি হয়। সূর্যের কেন্দ্রের প্রবল ঘনত্ব ও প্রচন্ড তাপমাত্রা নিউক্লিয় সংযোজনের পক্ষে যথেষ্ট। আবার বিক্রিয়ায় উৎপন্ন তাপ যে পরিমাণ বাহ্যিক চাপ দেয় তা সূর্যকে তার কেন্দ্রে সংকোচিত হতে বাঁধা দেয়। এরফলে সূর্যের কেন্দ্রে স্থায়ী নিউক্লিয় সংযোজন হওয়ার কারখানা হিসেবে থেকে যাচ্ছে।
♦ ম্যাগনেটোস্ফিয়ার ও আয়নোস্ফিয়ার-
সূর্য থেকে আগত গতিশীল আহিত কণা মহাশূন্যে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। যাকে সৌরবায়ু বলা হয়। পৃথিবীর নিজস্ব চৌম্বক ক্ষেত্রে যখন এই সৌরবায়ু আঘাত করে তখন শক্তি বিকিরণের জন্য রঙিন ছটা তৈরি হয়। একে 'aurora borealis' বা 'Northern light' বলা হয়।
♦ তড়িৎ মোক্ষণ (Gas discharge)-
এই প্রক্রিয়াটি মানুষের তৈরি। আবদ্ধ কাচ পাত্রে নিম্ন চাপে উচ্চ বিভব স্থাপন করলে এই ঘটনা দেখা যায়। উচ্চবিভবে ইলেকট্রন পরমাণুর কক্ষপথ থেকে প্রবল শক্তি নিয়ে বেরিয়ে আসে। বের হওয়ার সাথে সাথে প্রবল বেগে ক্যাথোড থেকে অ্যানোডের দিকে ছুটতে থাকে বাঁধাহীন ভাবে। গতিপথের মাঝে অন্য পরমাণুর ইলেকট্রনের সাথে ধাক্কা খেলে আরও ইলেকট্রনের স্রোত তৈরি করে; যা একপ্রকার প্লাজমা। বজ্রপাত ও বিদুৎ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটি একই প্রকারের।
আগুন কি প্লাজমা?
আগুনও কিন্তু প্লাজমা। তবে পূর্ণরূপে নয়। কোনো কিছুর দহন মানেই অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া। বিক্রিয়া চলাকালীন মানে পরমাণুদের ইলেকট্রন আদান প্রদানের সময় আয়ন বা প্লাজমা তৈরি হচ্ছে ঠিকই তবে এর মধ্যে দহন থেকে বেঁচে যাওয়া অণু-পরমাণু মিশে থাকে। সেজন্য আগুনকে আংশিক প্লাজমা বলা যেতে পারে।
তথ্য সূত্র-
1. https://lasers.llnl.gov/science/understanding-the-universe/plasma-physics
2. An Introduction to Laboratory, Space, and Fusion Plasmas- Alexander Piel
3. wikipedia